সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ভুবনকে হারিয়ে হাহাকার করছে পরিবার

একমাত্র মেয়ে ভূমিকা শীল, স্ত্রী শিক্ষিকা রত্না রানী শীল ও অসুস্থ মা গিরিবালা শীলকে নিয়ে সাজানো সংসার ছিল আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের (৫৫)। নাম যেমন ভুবন, তেমনি স্ত্রী, সন্তান ও মায়ের জন্যও ছিলেন ভুবন। সেই ভুবনকে হারিয়ে আজ শুন্য পৃথিবীতে হাহাকার করছেন তারা।

ভুবনের মৃত্যুর খবর শোনার পর কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছেন স্ত্রী রত্না। ভুবনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে এক কাপড়ে ঢাকা চলে আসেন স্ত্রী রত্না ও মেয়ে ভূমিকা। পরিবারের অভিভাবকের উৎকণ্ঠায় পুরো সময় রাজধানীর ধানমন্ডি পপুলার হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের (সিসিইউ) সামনে সিঁড়িতেই কেটেছে মা-মেয়ের। ৮ দিন পর আজ ভুবনের নিথর দেহ নিয়ে নোয়াখালী ফিরছেন তারা। তবে ভুবনের মা এখনও ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন না।

সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা ৩৫মিনিটে যখন চিকিৎসকরা ভুবনকে মৃত ঘোষণা করেন, তখনও তার স্ত্রী রত্না হাসপাতালের সিঁড়িতে অপেক্ষায় ছিলেন। চিকিৎসকের মুখ থেকে ভুবনের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি বলে ওঠেন, ‘স্যার, ভুবন আমাদের রেখে মরতে পারে না। আপনারা আরও একটু চেষ্টা করে, তাকে মৃত ঘোষণা করবেন না। তার বাঁচানোর জন্য আরও চেষ্টা করুন। ও চলে গেলে এই শুন্য পৃথিবীতে আমি বেঁচে থেকে কী করবো।’

ভুবন গত ১৮ সেপ্টেম্বর বারিধারার গোমতী টেক্সটাইল লিমিটেডের অফিস থেকে মতিঝিলের আরামবাগের মেসে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। এদিন রাতে পৌনে ১০টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের গাড়ি ঘিরে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। এ সময় মামুন গাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌঁড় দিলে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। তাদের ছোড়া গুলিই মোটরসাইকেল আরোহী ভুবন ও পথচারী আরিফুল হক ইমনকে বিদ্ধ করে।

ঘটনার দিন থেকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় লাইফ সাপোর্টে ছিলেন ভুবন। আজ রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় আহত মামুন ও আরিফুল চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। 

স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে রত্না বলেন, কে গুলি করেছে, জানি না। আমার স্বামী তো চলেই গেল। যারা গুলি করেছে, তাদের বিচারটা যেন হয়।

তিনি আরও বলেন, এখন একটাই চাওয়া, এভাবে আর কোনো সন্তানের বাবাকে যেন পৃথিবী ছেড়ে যেতে না হয়। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।

ভুবনের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাসপাতলে ছুটে আসেন তার সহকর্মীরা। তারাই রত্নাকে বারবার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

বাবার মৃত্যুর খবর শুনে মা রত্নার কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল একমাত্র মেয়ে ভূমিকা। অস্পষ্ট কণ্ঠে ভূমিকা বলেন, বাবার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল ঘটনার আগের দিন রাত ১২টার দিকে। এ সময় বাবু বলছিল, কদিন পরই বাড়ি আসবো। তোমার জন্য কী আনতে হবে মা।

তিনি আরও বলেন, বাবু-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়া তারা মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে বাজি ধরতেন। আমি কাকে বেশি ভালোবাসি সেটা নিয়ে। কিন্তু আমি বাবুকেই বেশি ভালোবাসতাম। আবার বাবু ঢাকায় চলে এলে মাকে সরি বলতাম। এটা নিয়ে ফোনে আবার তাদের মধ্যে খুনসুটিও হতো।

কান্নাজুড়ে দিয়ে ভুবনের মেয়ে বলেন, এখন কাকে নিয়ে মজা করবো। বাবু তো আমাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন। বাবু আমাকে সবসময় মা বলে ডাকতেন। এখন আমাকে কে ডাকবে মা বলে। আর আমি কার মা হবো।

ভুবনের স্ত্রী রত্না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ভুবন খুব শখ করে একটি আংটি বানিয়ে দিয়েছিল। সেটাও ওর চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিলাম। তারপরও ভুবনকে বাঁচাতে পাড়লাম না।

নিহত ভুবনের স্ত্রীর বড় ভাই পলাশ মজুমদার বলেন, ভুবন ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলেও তার সংসারে সুখের অভাব ছিল না। আমার বোন নোয়াখালীর অরুনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষিকা ছিলেন। ভুবন ঢাকা আসতে বললেও বোন আসতো না। শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় এবং মেয়ের লেখাপড়ায় সমস্যা হবে ভেবে নোয়াখালী থেকে যায়।

তিনি বলেন, ভগ্নিপতির সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমার বাসায় যাওয়া আসাও করত। ওই ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল।

ভুবনের শ্যালক তাপস মজুমদার বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ গ্রামের বাড়ি ফেনীর পশুরাম এলাকার মাস্টারবাড়িতে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। তবে বড় সমস্যা ভুবনের মা এখনও তার ছেলের মৃত্যুর খবর জানেন না। ছেলে মারা গেছে শুনলে তাকেও বাঁচানো যাবে না।

এমএসি/আরএইচ